Poet Farrukh Ahmed











Description: http://immortalfame.blogspot.com/2010/06/blog-post_09.html
ইসলামি রেনেসাঁর প্রবক্তা কবি ফররুখ আহমদের জন্ম হয়েছিল যশোর জেলার মাগুরা থানার মাঝআইল গ্রামে ১৯১৮ সালের ১০ জুন। বাবা সৈয়দ হাতেম আলী ছিলেন ময়মনসিংহ ও খুলনার অত্যন্ত সৎ এবং পরিশ্রমী এক পুলিশ ইন্সপেক্টর। অন্যদিকে তিন বোনের পর যখন ফররুখ আহমদের জন্ম হয় তার মাত্র বছর ছয়েকের মাথায়ই মারা যান মা রওশন আখতার। তাই দাদির কাছেই শৈশবের একটা বড় সময় কেটেছে ফররুখ আহমদের। আর ছোটবেলায় এই দাদির মুখে গল্প শুনে শুনেই পুঁথির কাহিনী এবং বিভিন্ন ধর্মীয় গাঁথার প্রতি আগ্রহ জন্মে ফররুখ আহমদের মনে। এছাড়া স্বভাব-প্রকৃতিতে দুরন্ত হলেও একই সাথে প্রকৃতির সান্নিধ্যে একান্তে সময় কাটাতেও পছন্দ করতেন ফররুখ আহমদ। আর এসব কিছু মিলিয়েই সেই স্কুল জীবন থেকেই কবিতা লেখার নেশা পেয়ে বসেছিল তাকে। মূলত মাঝআইল গ্রামের পাঠশালাতেই হাতেখড়ি হয়েছিল ফররুখের। তারপর কলকাতায় গিয়ে মডেল এমই স্কুলে ভর্তি হন তিনি। এরপর কিছুদিন পড়েন বালিগঞ্জ হাই স্কুলে। বালিগঞ্জ হাই স্কুলে কবি গোলাম মোস্তফা তাঁর শিক্ষক ছিলেন। বালিগঞ্জ স্কুলে পড়ার সময় তিনি দিলকুশা স্ট্রিটে থাকতেন এবং রোজ সন্ধ্যার পর দিলকুশা পাবলিক লাইব্রোরিতে বই পড়তে যেতেন। সমবয়সী, পরবর্তীকালের বিখ্যাত কথাশিল্পী আবু রুশদও ঐ লাইব্রেরিতে প্রায় প্রতিদিন যেতেন। কখনো লাইব্রেরিতে বসে, কখনো পার্ক সার্কাস ময়দানের কোনো নিরালা কোণায়, কখনোবা হেঁটে গড়িয়াহাট লেক পর্যন্ত যেতে যেতে তাঁরা দু’জনে সাহিত্য নিয়ে আলোচনা করতেন। এর পর ফররুখ ভর্তি হন খুলনা জেলা স্কুলে। এই স্কুলে তাঁর শিক্ষক ছিলেন সাহিত্যিক আবুল ফজল ও কবি আবুল হাশেম। এই স্কুলের ম্যাগাজিনে ফররুখ আহমদের প্রথম কবিতা প্রকাশিত হয়। এই স্কুল থেকেই ১৯৩৭ সালে প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিক পাশ করেন তিনি। কলকাতায় এসে রিপন কলেজে ভর্তি হন। ১৯৩৯ সালে রিপন কলেজ থেকে তৃতীয় বিভাগে আইএ পাশ করার পর ঐ বছরই কলকাতার স্কটিশ চার্চ কলেজে দর্শনে অনার্স নিয়ে বিএ-তে ভর্তি হন। এরপর ১৯৪১ সালে স্কটিশ চার্চ কলেজ ছেড়ে কলকাতা সিটি কলেজে ইংরেজি সাহিত্যে অনার্স নিয়ে বিএ ক্লাসে ভর্তি হন। তাঁর অধ্যাপকমণ্ডলীর মধ্যে ছিলেন বুদ্ধদেব বসু, বিষ্ণু দে, প্রমথনাথ বিশী প্রমুখ। স্কুল-কলেজে তাঁর সহপাঠীদের মধ্যে ছিলেন বিখ্যাত চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায়, অভিনেতা ফতেহ লোহানী, কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়। তবে যে কোনো কারণেই হোক, শেষ পর্যন্ত বি.এ. পরীক্ষা দেননি তিনি। কলকাতায় থাকাকালীন ফররুখ আহমদ অনেকগুলা স্বল্পস্থায়ী চাকরি করলেও কোনোটিতেই মন বসেনি তার। কেবল ঢাকা বেতারেই তিনি কাজ করেছিলেন দীর্ঘদিন। ১৯৪৮ সালের শেষ দিকে তিনি কলকাতা থেকে ঢাকায় আসেন এবং ঢাকা বেতারে প্রথমে অনিয়মিত হিসেবে এবং পরে নিয়মিত স্টাফ আর্টিস্ট বা নিজস্ব শিল্পী হিসেবে কাজ করতে থাকেন এবং আমৃত্যু ঢাকা বেতারে স্টাফ আর্টিস্ট হিসেবে কর্মরত ছিলেন। বেতারে স্টাফ আর্টিস্ট হিসেবে ফররুখ আহমদ দীর্ঘকাল ‘কিশোর মজলিশ’ পরিচালনা করেছেন। বেতারের প্রয়োজনে অসংখ্য গান, কথিকা, নাটিকা, শিশুতোষ রচনা, গীতিনাট্য, গীতিবিচিত্রা ইত্যাদি লিখেছেন। এ সময় বেতারে তাঁর সহকর্মীদের মধ্যে ছিলেন কবি শাহাদাৎ হোসেন, কবি সৈয়দ আলী আহসান, কবি আবুল হোসেন, কবি সিকান্দার আবু জাফর, কবি শামসুর রাহমান, কবি হেমায়েত হোসেন, গীতিকার নাজির আহমদ, কথাশিল্পী আশরাফ-উজ-জামান খান, কথাশিল্পী নাজমুল আলম প্রমুখ।


১৯৩৭ সালে ফররুখ আহমদ প্রথম সাহিত্য জগতে আত্মপ্রকাশ করেন। কারণ এবছরই বুলবুল ও মোহাম্মদী-তে তাঁর প্রথম রচনাবলি প্রকাশিত হয়। এর মধ্যে যতদূর জানা যায় বুলবুলে প্রকাশিত ‘রাত্রি’ সনেটটিই তাঁর প্রথম মুদ্রিত কবিতা। এছাড়া দীর্ঘ কাব্য জীবনে এক হাজারেরও বেশি সনেট এর রচয়িতা ফররুখ আহমদ প্রথম দিকে গল্প লেখাতেও বেশ মন দিয়েছিলেন। এর মধ্যে সওগাত, বুলবুল এবং মোহাম্মদী পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল তার লেখা ‘মৃত বসুধা, যে পুতুল ডলির মা’ এবং ‘প্রচ্ছন্ন নায়িকা’সহ বেশ কিছু গল্প। এছাড়া মৃত্তিকা পত্রিকায় ‘সিকান্দার শা’র ঘোড়া’ নামের একটি উপন্যাস লেখা শুরু করলেও সে সময় তা আর শেষ করেননি ফররুখ। যদিও কথাসাহিত্যের এই ছোট্ট ধারাটির পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া ফররুখের কাব্যের নদীটি কিন্তু ছিল সবসময়ই একই রকম খরস্রোতা আর তেজস্বী। আর বহমান এই ধারায় তার উল্লেখ করবার মতো কবিতার সংখ্যাও অগণিত। ১৯৪৪ সালে সাত সাগরের মাঝি প্রকাশিত হলে সওগাত-মোহাম্মদী প্রভৃতি পত্রিকায় তার দীর্ঘ আলোচনা ছাপা হয়। ১৯৪৩ সালের দুর্ভিক্ষে ফররুখ আহমদের লেখা ‘লাশ’, ‘আউলাদ’ প্রভৃতি কবিতা কিংবা ১৯৪৬ সালের হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গার সময় কবির মানবিক পঙক্তিমালা ‘বন্ধু’, ‘নিজের রক্ত’ প্রভৃতি তুমুল আলোচনা তৈরি করে। যদিও সে সময়কার প্রথম শ্রেণীর প্রায় সব সাময়িকী এবং পত্রিকাতে কবির কবিতা নিয়মিত স্থান পেলেও কলকাতা জীবনে মাত্র দু’টি কাব্যগ্রন্থই (সাত সাগরের মাঝি ও আজাদ করো পাকিস্তান) প্রকাশিত হয়েছিল। ১৯৪৮ সালে ফররুখ ঢাকায় চলে আসার পর মৃত্যুকাল পর্যন্ত ঢাকাই ছিল তার সাহিত্যক্ষেত্র। ১৯৪৮-৭৪ এই প্রায় তিন দশক তিনি অবিরত সাহিত্য চর্চা করেছেন। এই বছরগুলোতে তার চারটি কাব্যগ্রন্থ এবং চারটি শিশুতোষ গ্রন্থ প্রকাশিত হয়। এ সময়ে ফররুখ আহমদ কয়েকটি গদ্য ও কাব্য-নাট্যও লিখেছিলেন। এর মধ্যে ‘দরিয়ায় শেষ রাত্রি’ (সাত সাগরের মাঝি গ্রন্থভুক্ত), ‘তৈমুর’ এবং ‘নৌফেল ও হাতেম’ রেডিও-তে প্রচারিত হয় এবং ১৯৬১ সালে বাংলা একাডেমিতে ‘নৌফেল ও হাতেম’ নাটকটি মঞ্চস্থও করা হয়। অন্যদিকে ঢাকা বেতারে যুক্ত থাকাকালীন সময়ে ফররুখ আহমদ বেশ কিছু আধুনিক, দেশাত্মবোধক, ইসলামি ও উদ্দীপনামূলক গান, গজল, হামদ ও নাত রচনা করেন।


কবি ফররুখ আহমদ একসময় পাকিস্তান আন্দোলনকে সমর্থন করলেও পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর তার স্বপ্নভঙ্গ হয়েছিল। শাসকদের নীচতা আর হীনতায় বিস্মিত কবি অজস্র ব্যঙ্গ কবিতায় এদের ঘায়েল করেছিলেন। এমনকি একাধিক ছদ্মনামে বিদ্রুপাত্মক কবিতা লেখা সত্ত্বেও একবার পাকিস্তানি শাসকদের রোষানলে পড়ে পালিয়ে বেড়াতে হয়েছিল তাকে। এছাড়া বায়ান্ন’র রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনেও বাংলা ভাষার পক্ষে শক্ত অবস্থান নিয়েছিলেন তিনি। এমনকি ১৯৬৬ সালে পাকিস্তান সরকার ফররুখ আহমদকে ‘সিতারা-ই-ইমতিয়াজ’ খেতাবে ভূষিত করলে তিনি তা প্রত্যাখ্যানও করেছিলেন। ১৯৭১ সালের শেষে বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পর ফররুখ আহমদ একান্ত গৃহবাসী হয়ে পড়েন। কিন্তু তখনো নিভৃতে সাহিত্যচর্চা করেছেন তিনি। বিশেষ করে কোরআন-শরিফের পূর্বকৃত তরজমা এবং হামদ ও নাতের পরিমার্জনা, গাদ্দাফিকে নিয়ে একগুচ্ছ কবিতা, ‘নজরে আকিদাত’ নামে একটি উর্দু দীর্ঘ কবিতার তরজমা, হিটলারের সঙ্গে সংলাপ- এমন একটি বিষয় নিয়ে গদ্যরচনা এবং মৃত্যুর অল্প কিছুদিন আগে লেখা একটি অসামান্য সনেট ছিল তার এই সময়কার সাহিত্যচর্চার উল্লেখযোগ্য দিক। মৃত্যুর দু’মাস আগে অসামান্য একটি সনেট। ১৯৭৪ সালের ১৯ অক্টোবর, সন্ধেবেলা ঢাকায় ইস্কাটন গার্ডেনে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।


জীবদ্দশায় অসংখ্য পাঠক আর সমালোচকের অকুণ্ঠ ভালোবাসা ছাড়াও কবি ফররুখ আহমদ পেয়েছিলেন প্রেসিডেন্ট পুরস্কার, ‘প্রাইড অব পারফরমেন্স’, বাংলা একাডেমী পুরস্কার, হাতেম তায়ী গ্রন্থের জন্য আদমজী পুরস্কার এবং পাখীর বাসা গ্রন্থের জন্য ইউনেস্কো পুরস্কার। অন্যদিকে মৃত্যুর পর ‘একুশে পদক’, ‘স্বাধীনতা পুরস্কার’ ও ‘ইসলামিক ফাউন্ডেশন পুরস্কার’-এ ভূষিত করা হয় নব জাগরণের এই কবিকে।